

হাজী মুহাম্মদ মহসিন ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার একজন প্রখ্যাত মুসলিম জনহিতৈষী, ধার্মিক, উদার ও জ্ঞানী ব্যক্তি, যিনি তাঁর নিজের দানশীলতার মহৎ গুণাবলীর জন্য দানবীর খেতাব পেয়েছিলেন। যদিও তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন, যার ফলস্বরূপ তিনি সেসময়ে বিপুল সম্পত্তি আয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই বিপুল সম্পত্তির মালিকানা হয়েও তিনি কেবল একটি খুব সহজ ও অযৌক্তিক জীবনযাপন করেননি, বরং তিনি যথাযথ শিক্ষা, চিকিৎসা সেবা এবং দরিদ্র মানুষের দুর্দশা ও দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য তার সম্পত্তির বিশাল আত্মত্যাগ করেছিলেন।
মহসীনের সম্পদ পশ্চিমবঙ্গ এবং বর্তমান বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের মধ্যে ঐতিহ্যগত ও আধুনিক শিক্ষা অর্জনের সুযোগ ছড়িয়ে দিয়েছে। হুগলি, ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা এবং রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠিত কিছু স্কুল, মাদ্রাসা এবং কলেজে তার অনুদানের অর্থ দিয়ে এখনও অনেক বিষয়ে স্নাতকোত্তর স্তরের কাঠামো প্রদান করে এবং উৎকর্ষ কেন্দ্র হিসাবে বিবেচিত হয়।
মুহাম্মদ মহসিন ১৭৩০ মতান্তরে ১৭৩২ সালে হুগলির এক সম্ভ্রান্ত ধনী মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা হাজি ফয়জুল্লাহ ও মা জয়নাব খানম। ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায়, তাঁর পূর্বপুরুষরা পারস্য বা ইরান থেকে বাংলায় এসেছিলেন। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমজাদ হোসেন আরও ব্যাখ্যা করে বলেন, সতেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে মহসিনের পিতামহ আগা ফজলুল্লাহ তার তরুণ পুত্র ফয়জুল্লাহকে নিয়ে ইরান থেকে বাণিজ্য করতে এসে মুর্শিদাবাদে বসবাস করতে শুরু করেন। মহসিনের পিতা ফয়জুল্লাহ ছিলেন একজন ধনী জায়গীরদার। জয়নব ছিলেন ফয়জুল্লাহর দ্বিতীয় স্ত্রী। জয়নবের পূর্বেও বিয়ে হয়েছিল। মন্নুজান খানম নামে তার সাবেক স্বামী আগা মোতাহারের একটি মেয়েও ছিল। আগা মোতাহারও বিপুল সম্পদের মালিক ছিলেন। বাদশাহ আওরঙ্গজেব আগা মোতাহারকে এই অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। সেই সময় তাকে জমিদারিও দেয়া হয়। হুগলি, যশোর, মুর্শিদাবাদ ও নদীয়ায় তার জায়গির ছিল। আগা মোতাহারের সম্পত্তি তার মেয়ে মন্নুজান উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জন করেছিলেন। মহসিন তার সৎ বোন মন্নুজান খানমের থেকে আট বছরের ছোট ছিলেন। সৎ হলেও প্রথম থেকেই তিনি অনুগতভাবে তাঁর প্রতি বড় বোনের দ্বায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং তাঁর প্রথম বছরগুলিকে কোমল ভক্তির সাথে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। হাজী ফয়জুল্লাহর পরিবারে একত্রে বেড়ে ওঠা নবজাতক দুই শিশু তারা নিজেদের অবিচ্ছেদ্য সক্ষম সঙ্গী ছিল এবং শৈশব দিনের প্রথম স্মৃতি হিসেবে তাদের মধ্যে যে দৃঢ় ও গভীর স্নেহ সর্বদা বিদ্যমান ছিল। মন্নুজান তার উপর যে ভালো প্রভাব ফেলেছিলেন তা পরবর্তী জীবনে তার ছাপ রেখে যায় এবং মহম্মদ মহসিনও তার ঋণের কথা ভুলে যাননি।
সেকালের স্বাভাবিক মুহম্মদীয় রীতি অনুসরণ করে, মহম্মদ মহসিন প্রথম দিকে আরবি ও ফারসি ভাষায় তার পড়াশোনার বিচার শুরু করেছিলেন। সে বিষয়ে আবার তিনি তার বোনের নির্দেশনার সুবিধা পেয়েছিলেন, সুতরাং তিনি ইতিমধ্যেই সেই অধ্যয়নে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছিলেন যখন তিনি শিশু ছিলেন, এবং পরবর্তীতে যখন তার বয়স একটু বেশি হয়েছিল তখন এক গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে মহসিন ও তার আট বছরের বড় সৎ বোন মন্নুজানের সাথে শিক্ষার্জন করেছিলেন। তখন তিনি এইভাবেই তার পড়াশোনা চালিয়ে যান। তাদের সহপাঠী আগা শিরাজি নামে গৃহশিক্ষক ছিলেন একজন ফার্সি অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী ভদ্রলোক, যার কাছ থেকে মহসিন প্রচুর জ্ঞান অর্জন করেছিলেন, শিরাজি নিজের বাড়ি ছেড়ে শেষ পর্যন্ত হুগলিতে বসতি স্থাপনের আগে বহু দেশে ভ্রমণ করেছিলেন। পাঠ শেষ হলে, তিনি তার ছাত্রদের সাথে তার দুঃসাহসিক কাজ এবং বিদেশী ভূখণ্ডের বিস্ময়কর গল্পগুলি সম্পর্কে বলতেন না বরং তার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও সেই সম্পর্কিত ঘটনা সম্পর্কে দৃষ্টিপাত করতেন এবং পরবর্তীতে এইভাবে প্রথম দিকে মহম্মদ মহসিন ভ্রমণের সেই আকাঙ্ক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন যা বছরের পর বছরগুলিতে তিনি সে বিষয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার মতো সুযোগ করে দিয়েছিল। অবশেষে, তার শিক্ষা সমাপ্ত করার জন্য, মহম্মদ মহসিনকে মুর্শিদাবাদে পাঠানো হয়েছিল, সেখানে সেই সময়ের অন্যতম বিখ্যাত মুক্তাব তাকে কোরান এবং ইসলামী শিক্ষা শিখিয়ে ছিলেন, যা তাকে শৈশবকালে আগা শিরাজীর দ্বারা খুব ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এইভাবে পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষার জন্য রাজধানী মুর্শিদাবাদে তার শিক্ষা শেষ করেন। শিক্ষাজীবন শেষে ১৭৬৭ সালে বোন মন্নুজানের বিয়ে হলে তিনি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সফরে বেরিয়ে পড়েন। সফরকালে তিনি হজ পালন করেন। তিনি মক্কা, মদিনা, কুফা, কারবালাসহ ইরান, ইরাক, আরব, তুরস্ক এমন নানা স্থান সফর করেছেন। সফর শেষে দীর্ঘ ২৭ বছর পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার পর তিনি তার বিধবা বোনের সম্পদ দেখাশোনা শুরু করেন। মন্নুজানের স্বামী মির্জা সালাহউদ্দিন ছিলেন হুগলির নায়েব ফৌজদার।
১৭৬৩ সালে সালেহ-উদ-দিন মারা যাওয়ার পরে মু্ন্নুজান তার দাতব্য কর্মকাণ্ড আরও বাড়িয়ে দেন। অধ্যাপক আমজাদ হোসেন লিখেছেন, তার যেহেতু কোন সন্তান ছিল না, তিনি প্রজাদেরই সন্তান বলে মনে করতেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুদান, মসজিদ তৈরি, কুয়া ও বিশাল পুকুর খনন, রাস্তাঘাট ও বাজার তৈরি করতে শুরু করেন। ধারণা করা হয়, বোনের এসব দাতব্য কর্মকাণ্ড মুহাম্মদ মুহসীনকে অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৮০৩ সালে মন্নুজানের মৃত্যুর পর মহসিন তার উত্তরাধিকারী হিসেবে সম্পদের মালিক হন।মুন্নুজান তার সমস্ত সম্পত্তি হাজী মুহাম্মদ মুহসীনের নামে লিখে দেন। সেই সময় হাজী মুহসীনের বয়স প্রায় ৭০ বছর। মহসিন খুব ধার্মিক ছিলেন এবং সহজসরল জীবনযাপন করতেন। তিনি চিরকুমার ছিলেন। বিপুল সম্পদ তিনি দানসদকায় ব্যয় করতেন। ১৭৬৯-৭০ সালের সরকারি দলিল অনুযায়ী তৎকালীন দুর্ভিক্ষের সময় তিনি অনেক লঙ্গরখানা স্থাপন করেন এবং সরকারি তহবিলে অর্থ সহায়তা প্রদান করেন। ১৮০৬ সালে তিনি মহসিন ফান্ড নামক তহবিল প্রতিষ্ঠা করে তাতে দুইজন মোতাওয়াল্লি নিয়োগ করেন। ব্যয়নির্বাহের জন্য সম্পত্তিকে নয়ভাগে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে তিনটি ভাগ ধর্মীয় কর্মকাণ্ড, চারটি ভাগ পেনশন, বৃত্তি ও দাতব্য কর্মকাণ্ড এবং দুইটি ভাগ মোতাওয়াল্লিদের পারিশ্রমিকের জন্য বরাদ্দ করা হয়।
হাজী মুহাম্মদ মহসিন ১৮১২ সালে হুগলিতে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে হুগলি ইমামবাড়ার পার্শ্ববর্তী গোরস্থানে দাফন করা হয়। ১৮৩৪ সাল নাগাদ ব্রিটিশ শাসকেরা তহবিল ব্যবহারের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়। তহবিলের আকার ছিল পাঁচ শতাংশ সুদে সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করা আট লাখ আটানব্বই হাজার চারশো রুপি এবং নগদ পাঁচ হাজার দুইশ ৪৩ রুপি। সরকারি বন্ড থেকে বছরের আয় ছিল ৪৪ হাজার ৩৯৪ রুপি। ১৮৩৫ সালে এই তহবিল দিয়ে 'মহসিন এডুকেশনাল এনডাউমেন্ট ফান্ড' তৈরি করে ব্রিটিশ সরকার।
হাজী মোহাম্মদ মুহসীন যেভাবে দানপত্র লিখেছিলেন, তাতে কিছু পরিবর্তন এনে ব্রিটিশরা দুইটি আলাদা তহবিল গঠন করে। তার একটিতে হাজী মহসিনের ইচ্ছা অনুযায়ী ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে ব্যয় যেমন শিয়া ধর্মকেন্দ্র ইমামবাড়ার খরচ, পেনশন প্রদান ও মোতোয়ালির বেতন ইত্যাদি খাতে ব্যয় হবে। সাধারণ ফান্ড নামের আরেকটি ফান্ড থেকে শিক্ষার পেছনে ব্যয় হবে। এই তহবিল থেকে ১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় হুগলি মহসীন কলেজ। এরপরে হুগলি কলেজিয়েট স্কুল, হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুল, হুগলি মাদ্রাসা, সিতাপুর মাদ্রাসা, ঢাকা চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়।
দানশীলতার কারণে তিনি কিংবদন্তীতে পরিণত হন এবং বর্তমানেও দানের ক্ষেত্রে তুলনা অর্থে তার দৃষ্টান্ত ব্যবহার হয়ে থাকে। হুগলি মহসীন কলেজ, হুগলি কলেজিয়েট স্কুল, হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুল, সিতাপুর মাদ্রাসা এবং হুগলি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার সময় মহসিনের ওয়াকফকৃত অর্থ ব্যবহৃত হয় এবং তার পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে দৌলতপুর মুহসিন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও "দৌলতপুর মুহসিন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়"। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ও ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বিএনএস হাজী মহসিন-এর নাম তার স্মরণে রাখা হয়েছে। মহসিন ফান্ডের আর্থিক সহায়তায় ১৮৭৪ সালে ঢাকায় ঢাকা মোহসীনিয়া মাদ্রাসা (বর্তমানে ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা ও কবি নজরুল সরকারি কলেজ), চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম সরকারি মাদ্রাসা (বর্তমানে হাজী মুহাম্মদ মহসিন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ও সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ) এবং রাজশাহীতে রাজশাহী মাদ্রাসা (বর্তমানে হাজী মুহম্মদ মুহসীন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, রাজশাহী) প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও মহসিন ফান্ডের অর্থে অসংখ্য দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়। খুলনার খুলনা মুহসিন কলেজ, মুহসিন মহিলা কলেজ ও দৌলতপুর মুহসীন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় এবং জয়পুরহাটের মহীপুর মহসীন কলেজ তাঁর নামে নামাঙ্কিত।